উদ্যোক্তা হতে চাও?

খ্যাতিমান উদ্যোক্তা ক্যামেরন হ্যারল্ডের জন্ম কানাডায়। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি প্রথম ব্যবসা শুরু করেন। বিভিন্ন দেশে নতুন উদ্যোক্তাদের তিনি প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। ২০১০ সালের মার্চ মাসে কানাডার এডমন্টনে টিইডির একটি অনুষ্ঠানে তিনি এই বক্তব্য দেন।

এখানে যাঁরা উপস্থিত আছেন, তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে আমি সবচেয়ে মাথামোটা! কারণ, আমি ভালোভাবে স্কুলই পাস করতে পারিনি। কিন্তু ছোটবেলাতেই বুঝতে পেরেছিলাম, আমি ব্যবসা বেশ ভালো বুঝি আর বড় হয়ে আমি উদ্যোক্তা হতে চাই।
ছোটবেলায় আমাদের অজস্র স্বপ্ন থাকে, শখ থাকে, জীবনে অনেক কিছু করার প্রবল ইচ্ছে থাকে। আর যখন আমরা বড় হয়ে যাই, আস্তে আস্তে সেসব স্বপ্ন বিবর্ণ হতে হতে মিলিয়ে যায়। আমাদের শুধু বলা হয়, পড়াশোনা করতে হবে, আরও অনেক পড়তে হবে প্রতিদিন, আরও মনোযোগী হতে হবে, আরও একজন শিক্ষকের কাছ প্রাইভেট পড়তে হবে! আমার মা-বাবা একজন শিক্ষক রেখেছিল আমাকে বাসায় এসে ফরাসি পড়ানোর জন্য; কিন্তু কোনো লাভই হয়নি। দুই বছর আগে এমআইটির (ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) ব্যবসায় উদ্যোগ-বিষয়ক মাস্টার্স প্রোগ্রামে আমি সেরা প্রভাষক নির্বাচিত হই। সেখানে আমাকে সারা পৃথিবী থেকে আসা উদ্যোক্তাদের সামনে বক্তব্য দিতে হয়। মজার ব্যাপার হলো, আমি যখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি, তখনই শহরের একটা বক্তব্য প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পাই। কিন্তু তখন কেউ আমাকে এতটুকু উৎসাহ দিয়ে বলেনি, ‘এই ছেলে তো দারুণ কথা বলতে পারে! হয়তো পড়াশোনায় তেমন মনোযোগী নয়, কিন্তু ও মানুষকে চমৎকারভাবে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।’ কেউ একবারও আমার মা-বাবাকে বলেনি, ‘ওকে বক্তৃতা শেখার জন্য একজন শিক্ষক দাও।’ সবাই বলেছে, ‘যেসব বিষয়ে পরীক্ষায় খারাপ করেছে, সেগুলো পড়তে পাঠাও।’
তাই শিশুদের শুধু চিকিৎসক বা প্রকৌশলী বানানোর চেষ্টা না করে উদ্যোক্তা হওয়ারও সুযোগ দিতে হবে। এটা খুবই দুঃখজনক যে আমাদের স্কুল-কলেজগুলো সবাইকে এটাই বোঝায় যে চিকিৎসক হতেই হবে, কিংবা প্রকৌশলী হতেই হবে। এতে আমরা অনেক সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তাকে নিজেদের অজান্তেই হারিয়ে ফেলছি। এমন অনেকে হয়তো এই কক্ষের মধ্যেই আছেন, যাঁদের কোনো কিছু করার তীব্র ইচ্ছে আছে, দারুণ কোনো পরিকল্পনা আছে। আমরা তাঁদের স্বপ্নপূরণে সাহায্য করতে পারি।
একটি প্রাচীন প্রবাদ আছে, ‘তুমি যদি কাউকে একটি মাছ দাও, তাহলে তুমি তার এক দিনের খাবারের ব্যবস্থা করলে। কিন্তু তুমি যদি কাউকে মাছ ধরা শেখাও তাহলে তুমি তার সারা জীবনের খাবারের ব্যবস্থাই নিশ্চিত করে দিলে।’ অভিভাবক ও সমাজের সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের উচিত শিশুদের হাতে মাছ তুলে না দিয়ে তা ধরতে শেখানো। আমরা যদি উদ্যোক্তা হওয়াকে একটি সম্ভাবনাময় জীবিকা হিসেবে মেনে নিয়ে ছেলেমেয়েদের উদ্যোক্তা হতে উৎসাহ আর সহায়তা দিই, তাহলে সরকারকে আর কখনো বেকারসমস্যা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
আমরা সারা দিন বসে বসে শিশুদের জ্ঞান দিই, কী কী করা উচিত নয়। কাউকে মেরো না, কামড় দিয়ো না, তর্ক কোরো না, এমন আরও শত শত বিধি-নিষেধ! আমরা তাদের বলি, সবচেয়ে ভালো চাকরিটাই পেতে হবে। স্কুলের শিক্ষক বলেন, চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হতে না পারলে আর জীবনে হলোটা কী! টেলিভিশন আর পত্রিকা তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়, যদি একবার মডেল, গায়ক কিংবা নায়ক হতে পারো, তাহলে তোমাকে আর পায় কে! আমাদের এমবিএ প্রোগ্রামে কখনো উদ্যোক্তা হতে শেখানো হয় না। সেখানে শুধু শেখানো হয়, কীভাবে বড় বড় কোম্পানির হয়ে চাকরি করতে হবে। কিন্তু একবার কি কেউ ভেবে দেখেছে, এসব বড় কোম্পানি তৈরি করছে কারা? তারা সংখ্যায় হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ, তারা উদ্যোক্তা। আর এদিকে আমরা কেবলই তোতাপাখির মতো শিখিয়ে যাচ্ছি, ‘উদ্ভট কিছু করার চেষ্টাও কোরো না। সবাই যা করে, সেটাই করো। ভালো ছাত্র হও।’ কিন্তু দুঃখিত, ক্লাসে প্রথম হলেই যে কেউ সবকিছু পারবে, তেমন নয়। আমি জোর গলায় স্বীকার করি, বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে আমি অন্যদের দিয়ে আমার অ্যাসাইনমেন্ট করিয়ে নিতাম।
এখন সেই একই বিষয়ের বইয়ে আমার উদাহরণ দেওয়া আছে। সারা কানাডার শিক্ষার্থীরা তা পড়ছে। বইটি লেখার সময় তাঁরা যখন আমার সাক্ষাৎকার নিতে এসেছিলেন, আমি না বলে পারিনি যে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে এই কোর্সে আমি কীভাবে পাস করেছিলাম!
উদ্যোক্তা হতে হলে এমবিএ করতেই হবে, স্কুলে ভালো ফল করতেই হবে—এমন কোনো কথা নেই।
আমরা কেন শিশুদের শেখাই না যে টাকাপয়সা যখন খুশি খরচ না করে কীভাবে জমিয়ে পরে ভালো কিছু করা যায়? আমি বড় রাস্তায় একবার একটা পয়সা ফেলে দেওয়ায় আমার বাবা আমাকে একা একা রাস্তার মাঝখানে গিয়ে সেটা তুলে আনার আদেশ করেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি খুব কষ্ট করে টাকা উপার্জন করি। আর তাই একটি পয়সাও নষ্ট হওয়া দেখতে চাই না।’ সেদিনের কথা আমি আজও ভুলিনি। হাতখরচ শিশুদের একটি বাজে ব্যাপারে অভ্যস্ত করে তোলে। এটি তাদের ‘বেতন’ আশা করতে শেখায়। একজন উদ্যোক্তা কখনো নির্দিষ্ট অঙ্কের বেতনের পেছনে ছোটেন না। আমার তিন ছেলেমেয়ে। আমি তাদের বলি বাড়িতে কোথাও কিছু ঠিকঠাক করা বা গোছানোর দরকার আছে কি না, তা খুঁজে বের করতে। তারা আমাকে এসে জানায়। তারপর আমরা আলোচনা করে ঠিক করি, কোনো একটি নির্দিষ্ট কাজের জন্য তাদের আমি কত পারিশ্রমিক দিতে পারি! হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে আমরা দর-কষাকষিও করি! কিন্তু এতে তাদেরই উপকার হয়। তারা চারপাশ থেকে সুযোগ খুঁজে নিতে শেখে, নিজের কাজ নিজেই করতে শেখে। এ ছাড়া কীভাবে কাজের যথাযথ দাম আদায় করতে হয়, তা-ও শিখে নেয়।
আমি বলব, শিশুদের ঘুমানোর সময় প্রতিদিন গল্প না শুনিয়ে সপ্তাহে তিন দিন অন্তত তাদের গল্প বলতে দেওয়া উচিত। তাদের জামাকাপড়, খেলনা কিংবা কম্পিউটার নিয়েই কিছু বলতে দিয়ে দেখুন না, সে কী গল্প বানায়! আমারসন্তানদের আমি এমনটি প্রায়ই করাই, এতে তারা সৃজনশীল হতে শেখে, নিজেদের মতো করে আনন্দও পায়। তাই শিশুদের কথা বলতে দিন, যা কিছু নিয়েই হোক না কেন। উদ্যোক্তা হতে হলে এসব দক্ষতা খুব প্রয়োজন।
আমরা নিজেদের জীবনে এগুলো নিয়ে সমস্যায় পড়লেও আমাদের শিশুদের গড়ে তোলার বেলায় এগুলোর কথা ভুলে যাই, আমরা শুধু ক্লাসের পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য প্রাইভেট টিচার দিয়েই মনে করি দায়িত্ব শেষ! কিন্তু না, তাদের নেতৃত্ব দিতে শেখাতে হবে। তাদের মনে মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে, আত্মনির্ভরশীল হতে জানতে হবে।
সূত্র: ওয়েবসাইট
ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: অঞ্জলি সরকার

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More

 
Design by Free WordPress Themes | Bloggerized by Lasantha - Premium Blogger Themes | Web Hosting Bluehost